বাচ্চাদের চুল পড়া রোগের চিকিৎসা কি?

বাচ্চাদের চুল পড়া রোগের চিকিৎসা কি?

অনেক মা অভিযোগ করে থাকেন যে তার বাচ্চার মাথার চুল খুবই পাতলা অথবা অস্বাভাবিক ভাবে মাথার চুল পড়ে যাচ্ছে। বড়দের মতো বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও চুল পড়ে যেতে পারে তবে তা কখনো কখনো স্বাভাবিক হিসেবে ধরা হয়। আবার অনেক বাচ্চার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো সমস্যার কারণে চুল পড়তে পারে যার জন্য প্রয়োজন যথাযথ চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করা।

এই অনুচ্ছেদে বাচ্চাদের চুল পড়ার কারণ এবং চুল পড়ার ক্ষেত্রে কোন লক্ষণ গুলো স্বাভাবিক সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।‌ সেই সাথে বাচ্চাদের চুল পড়ার কোন অবস্থায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে এবং চুলের যত্নে ঘরোয়া পদ্ধতিতে করণীয় বিষয়াবলী সমূহ অনুচ্ছেদের শেষের দিকে তুলে ধরা হয়েছে।

বাচ্চাদের চুল পড়ার কারণ

American Academy of Pediatrics (AAP) এর তথ্য অনুযায়ী জন্মের পর থেকে শুরু করে কয়েক মাস বয়স পর্যন্ত শিশু বাচ্চাদের ক্ষেত্রে মাথার চুল পড়ে যাওয়াকে স্বাভাবিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে চুল পড়ার ক্ষেত্রে রয়েছে নানাবিধ কারণ যার মধ্যে কোনটি শরীরের হরমোনের সাথে সম্পর্কিত আবার কোনটি হয়তো বিশেষ প্রকৃতির চর্মরোগ। কারো কারো ক্ষেত্রে আবার পুষ্টিকর খাবারের অভাবে চুল পড়ে যেতে পারে। তো চলুন চুল পড়ার কারণ গুলো সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

১. এন্ডোক্রাইন সমস্যা 

এন্ডোক্রাইন (Endocrine) একটি মেডিকেল টার্ম যা দ্বারা হরমোন সম্পর্কিত চুল পড়া সমস্যা গুলোকে বোঝানো হয়। অনেক শিশু বাচ্চার ক্ষেত্রে জন্মের পর থেকেই শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা দেখা যায়। বিশেষত থাইরয়েডের সমস্যা (হাইপোথাইরয়েডিজম- Hypothyroidism) এক্ষেত্রে খুবই কমন একটি রোগ যার প্রভাবে মাথার চুল পড়ে যেতে পারে। হাইপোথাইরয়েডিজমের ক্ষেত্রে থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে হরমোন নিঃসরণ হয় না যার ফলে চুল পড়া ছাড়াও আরো যে সমস্ত লক্ষণ দেখা যায় তা হলো:

  • ত্বক ও চোখে হলদে ভাব (Jaundice)
  • কোষ্ঠকাঠিন্য (Constipation)
  • শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত হয়
  • পুরু জিহ্বা (large, swollen tongue) ইত্যাদি

থাইরয়েড ছাড়াও পিটুইটারি গ্রন্থির সমস্যার (Hypopituitarism) দরুন শিশু বাচ্চাদের মাথার চুল পড়ে যেতে পারে। তবে এটি খুবই বিরল প্রকৃতির একটি রোগ যা সচরাচর হতে দেখা যায় না। আপনার বাচ্চার ক্ষেত্রে কোন হরমোনের সমস্যা থেকে চুল পড়ছে সেটি চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত ভাবে নির্ণয় করা যায়।

২. Alopecia Areata

Alopecia areata একটি অটো ইমিউন ডিজিস (Autoimmune disease) যেক্ষেত্রে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অস্বাভাবিকতার দরুন মাথার চুল পড়ে যায়। এই রোগের সংক্রমণ হঠাৎ করে হয়ে থাকে তবে এটি কোনো ছোঁয়াচে প্রকৃতির রোগ নয়। প্রাথমিক অবস্থায় মাথার কোনো একটি অংশে গোল হয়ে চুল পড়ে গেলেও যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে একসময়ে মাথার সমস্ত চুল পড়ে যেতে পারে যাকে মেডিকেলের ভাষায় alopecia totalis বলা হয়।

৩. টেলোজেন ইফ্লুভিয়াম 

একটি শিশু বাচ্চা তার মায়ের গর্ভে অবস্থান কালীন ১৪তম সপ্তাহ থেকে মাথায় হেয়ার ফলিকল (Hair follicle) জন্মাতে শুরু করে। হেয়ার ফলিকল মানে হলো এমন কোষ যেখান থেকে চুলের গোড়া উৎপাদন হয় তথা চুল গজাতে থাকে। শিশু জন্মের পর সব গুলো হেয়ার ফলিকল থেকে চুল গজায় না বরং অধিকাংশই নিষ্ক্রিয় অবস্থায় (telogen phase) থাকে যেখান থেকে পরবর্তীতে চুল গজায়।

সাধারণত শিশুর বয়স ৬ মাস পর্যন্ত চুল পড়া সমস্যাকে টেলোজেন ইফ্লুভিয়াম এর প্রভাব জনিত চুল পড়া হিসেবে বিবেচনা করা হয় যা স্বাভাবিক এবং শিশুর বয়স সর্বোচ্চ ১ বছরের মধ্যেই এই সমস্যা আপনাআপনি ঠিক হয়ে যায়। তবে শিশু পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টি না পেলে, কোনো ধরনের সার্জারি হলে, মায়ের শরীরে পুষ্টির অভাব অথবা অযাচিত ওষুধের ব্যবহারের প্রভাবে Telogen phase বৃদ্ধি পেতে পারে তথা অস্বাভাবিক ভাবে মাথার চুল পড়ে যায় যেক্ষেত্রে একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।

৪. ট্রাইকোটিলোম্যানিয়া (Trichotillomania)

অনবরত চুল টানা বা ঘোরানো অথবা মোচড়ানোর প্রভাবে চুল পড়তে থাকলে তাকে ট্রাইকোটিলোম্যানিয়া (Trichotillomania) বলা হয়। সাধারণত এই সমস্যাটি হতে দেখা যায় কতিপয় মানসিক রোগ অথবা অস্বাভাবিক আচরণ জনিত প্রভাবে। যেমন: OCD- obsessive compulsive disorders একটি মানসিক রোগ যার ফলে রোগী ক্রমাগত একই কাজ করতে থাকে। সেক্ষেত্রে অনেক বাচ্চা অবচেতন ভাবে মাথার চুল টানতে থাকা অথবা মোচড়ানোর ফলে চুলের গোড়া আঘাত প্রাপ্ত হয়ে চুল পড়তে পারে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য তেমন কোনো চিকিৎসা গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে না। তবে মানসিক সমস্যা সমাধানে কাউন্সেলিং (Counseling) করানো অথবা অভ্যাস পরিবর্তনের জন্য মা বাবার একান্ত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

৫. ট্র্যাকশন অ্যালোপেসিয়া (Traction Alopecia)

এই সমস্যাটি শিশুদের ক্ষেত্রে হওয়ার প্রধান একটি কারণ সারাক্ষণ একপাশ হয়ে শুয়ে থাকা যার ফলে মাথার একটি অংশে ঘর্ষণের ফলে চুল পড়ে যেতে থাকে। ছোট মেয়ে বাচ্চাদের চুল শক্ত বেণী করে রাখার প্রভাবে চুল পড়াও ট্রাকশন অ্যালোপেসিয়া (Traction alopecia) এর অন্তর্ভুক্ত। এই সমস্যা সমাধানের সহজ সূত্র হলো শিশুকে সারাক্ষণ একপাশ করে শুয়ে না রাখা এবং মেয়ে বাচ্চাদের চুলে সারাক্ষণ বেণী করে না রাখা বিশেষত রাতের বেলায় অবশ্যই চুলে বেণী করে রাখা যাবে না।

৬. Ringworm (Tinea capitis)

আরেকটি কারণে শিশু বাচ্চাদের মাথায় চুল পড়ে যাকে মেডিকেলের ভাষায় Tinea capitis বলা হয় যা সাধারণ ভাবে Ringworm নামে পরিচিত। এটি একধরনের ফাংগাল ইনফেকশন যা ভীষণ ছোঁয়াচে প্রকৃতির হয়ে থাকে। আর তাই এই সমস্যার ক্ষেত্রে একটি বাচ্চার ব্যবহৃত বালিশ, টুপি, তোয়ালে ইত্যাদি আরেকজনের জন্য ব্যবহার করা উচিত নয়।

বাচ্চাদের চুল পড়ার ক্ষেত্রে কোন লক্ষণগুলো স্বাভাবিক?

প্রায় সব ক্ষেত্রেই ছোট বাচ্চাদের জন্য চুল পড়া স্বাভাবিক যদি না মাথার ত্বকে কোনো চর্মরোগ দেখা দেয়। যেমন: বালিশ অথবা বিছানায় চুল পড়ে থাকা, চুল আঁচড়ানোর সময় কিছু চুল উঠা, গোসলের সময় চুল পড়া ইত্যাদি। তবে চুলের গোড়া যদি এতই দুর্বল হয়ে যায় যে একটু হাত বুলানোর ফলেই অনেক বেশি চুল পড়তে থাকে তবে সেক্ষেত্রে এটিকে অস্বাভাবিক হিসেবে ধরা হয়।

অনেক বাচ্চাদের ক্ষেত্রে জন্মের পরে মাথায় একদমই চুল দেখতে পাওয়া যায় না। তবে এটি প্রকৃতপক্ষে কোনো টাক (Bald) নয় বরং শিশুর বয়স সর্বোচ্চ ১ বছর পর্যন্ত বাচ্চার মাথার চুলের ঘাটতি বিষয়টি নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা না করে একদম স্বস্তিতে থাকা উচিত।

বাচ্চাদের চুল পড়া রোগের চিকিৎসা কি?

এন্ডোক্রাইন বা হরমোনের সমস্যা এবং Alopecia areata সমাধানের জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে। হরমোনের চিকিৎসা হিসেবে চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী নিয়মিত হরমোন থেরাপি অথবা ওষুধ সেবন করতে হবে। Alopecia areata এর জন্য স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ (corticosteroid) নির্দেশিত হয়ে থাকে তবে এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। সুতরাং ওষুধ গ্রহণের ব্যাপারে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

Ringworm সমস্যা সমাধানের জন্য চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী নিয়মিত এন্টি ফাংগাল (antifungal) ওষুধ সেবন করতে হয় এবং সেই সাথে ফাংগাস ধ্বংসকারী ক্রিম অথবা শ্যাম্পু (selenium sulfide বা ketoconazole) ব্যবহার করতে হবে।

বাচ্চাদের চুলের যত্নের টিপস

ছোট বাচ্চাদের চুলের যত্ন কিভাবে নিতে হবে তা নিয়ে অনেকের মনেই নানাবিধ প্রশ্ন রয়েছে। এই বিষয়ে সঠিক নির্দেশনা সমূহ নিচে তুলে ধরা হলো:

  • বাচ্চার মাথার চুল খুব বেশি বড় না রাখা উত্তম। কারণ চুল বেশি বড় হলে ময়লা হতে পারে এবং চুল টানার ফলে চুলের গোড়া আঘাত প্রাপ্ত হবে এবং চুল পড়ার পরিমাণ বাড়বে
  • মাথার চুল পরিষ্কার করতে সপ্তাহে ২ থেকে ৩ দিন শ্যাম্পু ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে বড়দের শ্যাম্পু ব্যবহার না করে বরং শিশুদের জন্য বিশেষভাবে তৈরিকৃত শ্যাম্পু ব্যবহার করুন
  • মাথায় প্রতিদিন তেল অথবা লোশন ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই। তবে মাথার ত্বক খুব শুষ্ক মনে হলে সেক্ষেত্রে মাঝে মধ্যে নারিকেল তেল, খাঁটি সরিষার তেল অথবা অলিভ অয়েল ব্যবহার করা যেতে পারে

আবার চুল গজানোর ক্ষেত্রে কি করা যায়?

ছোট বাচ্চাদের মাথার চুল বেশ পাতলা থাকলে সেক্ষেত্রে চুল গজানোর জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি বা ভেষজ উপাদান ব্যবহার করতে হবে না। তবে শরীরের জন্য যেমন পুষ্টি দরকার তেমনি ভাবে চুলের জন্যও পুষ্টি সরবরাহ করতে হবে। আর তার জন্য বাচ্চাকে নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার বিশেষত প্রোটিন (মাছ, মাংস, ডিম, দুধ), শাকসবজি, ফলমূল, ভিটামিন সি ইত্যাদি খেতে দিতে হবে। সেই সাথে বায়োটিন (Biotin) এবং জিংক (Zinc) সমৃদ্ধ খাবার সরবরাহ করতে হবে যা চুল গজানো সহ শিশুর সার্বিক গঠন, বৃদ্ধি ও বিকাশে সহায়তা করে থাকে। মিষ্টি আলু, বাদাম, কলা, ডিমের কুসুম, কলিজা, মাশরুম ইত্যাদি খাবার থেকে বায়োটিন পাওয়া যায়।

উল্লেখ্য ভিটামিন এবং পুষ্টি উপাদান যেমন চুলের যত্নে সহায়তা করে থাকে তেমনি ভাবে অতিরিক্ত ভিটামিনের উপস্থিতি চুল পড়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিশেষত শরীরে ভিটামিন এ (Vitamin A) এর মাত্রা বেড়ে গেলে তার প্রভাবে বাচ্চার মাথার চুল পড়ে যায়। সাধারণত অযাচিত পরিমাণে ভিটামিন এ সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের ফলে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে আর তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কখনোই বাচ্চার জন্য ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট দেওয়া উচিত নয়।

শিশু বাচ্চাদের চুল পড়া একটি সাময়িক সমস্যা যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আপনাআপনি ঠিক হয়ে যায়। আর তাই অহেতুক দুশ্চিন্তা না করে বাচ্চার জন্য পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করুন এবং নির্দেশিত উপায় সমূহ অবলম্বন করে চুলের যত্ন নিন। তবে কোনো শারীরিক সমস্যার দরুন চুল পড়লে অথবা মাথায় চর্মরোগ দেখা দিলে সেক্ষেত্রে একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।