চিনা বাদাম কাঁচা খাওয়া ভালো নাকি ভাজা

চিনা বাদাম কাঁচা খাওয়া ভালো নাকি ভাজা? চিনা বাদামের ১২ টি উপকারিতা

প্রচলিত ভাবে বাদাম বলতে চিনা বাদাম (Peanuts) কেই বোঝানো হয়ে থাকে যা কমবেশি সবাই খেয়ে থাকেন। তবে অতি পরিচিত এই খাদ্য উপাদানটি সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য রয়েছে। যেমনঃ উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের মতে এটি মূলত বাদাম নয় যা শুনে রীতিমতো বিস্ময়কর লাগছে হয়তো! সেই সাথে চিনা বাদাম কাঁচা নাকি ভাজা খেলে পুষ্টিগুণ সবচেয়ে ভালো পাওয়া যায় এবং তা কতটুকু পরিমাণে খেলে ক্ষতিকর হতে পারে এই সাধারণ বিষয়গুলো সম্পর্কে সকলেরই জানা প্রয়োজন।

আর তাই আজকের এই অনুচ্ছেদে আমরা কথা বলবো চিনা বাদাম নিয়ে। চিনা বাদাম কোন প্রকৃতির খাবার, এর মধ্যে কি কি পুষ্টিগুণ রয়েছে, ভাজা খেলে ভালো নাকি কাঁচা অবস্থায় খেতে হবে, খোসা ফেলে দেওয়া উচিত হবে কিনা ইত্যাদি বিষয়গুলো সহ চিনা বাদামের ১২ টি উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।

চিনা বাদাম কেন বাদাম নয়?

উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা সমস্ত উদ্ভিদ জগতকে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ করেছেন। সেই হিসেবে বাদাম (Nut) বলতে বোঝায় বড় গাছে ধরে এমন তৈলাক্ত বীজ অথবা ফল। যেমনঃ কাঠবাদাম (Almonds), কাজুবাদাম, পেস্তাবাদাম, হ্যাজেলনাট বাদাম, আখরোট ইত্যাদি।

চিনা বাদাম মাটির নিচে শস্যদানার মতো হয়ে থাকে যা Legumes গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। তবে মজার বিষয় হলো এটি সারা বিশ্বব্যাপী বাদাম হিসেবেই পরিচিত এবং এর মধ্যে অন্যান্য বাদামের মতোই নানাবিধ পুষ্টিগুণ রয়েছে। আমেরিকাতে এটি একটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাবার হিসেবে জনপ্রিয় যা ১৮০০ সালের দিক থেকে ব্যাপকভাবে চাষাবাদ হয়ে আসছে।

চিনা বাদামের পুষ্টিগুণ (প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁচা বাদাম অনুপাতে)

যুক্তরাষ্ট্রের Department of Agriculture এর তথ্য মতে প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁচা বাদামের (Raw peanuts) মধ্যে কোন পুষ্টি উপাদান কতটুকু পরিমাণে রয়েছে তা ছকের মাধ্যমে তুলে ধরা হলো

পুষ্টিগুণ পরিমাণ
শক্তি ৫৬৭ ক্যালরি
প্রোটিন ২৫.৮ গ্রাম
শর্করা ১৬.১৩ গ্রাম
ফাইবার (fiber) ৮.৫ গ্রাম
চিনি (Sugars) ৪.৭২ গ্রাম
মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট ২৪.৪৩ গ্রাম
পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট ১৫.৫৬ গ্রাম
স্যাচুরেটেড ফ্যাট ৬.২৮ গ্রাম

 

খনিজ (Minerals) পরিমাণ
পটাশিয়াম ৭০৫ মিলিগ্রাম
ফসফরাস ৩৭৬ মিলিগ্রাম
ম্যাগনেসিয়াম ১৬৮ মিলিগ্রাম
ক্যালসিয়াম ৯২ মিলিগ্রাম
সোডিয়াম ১৮ মিলিগ্রাম
আয়রন ৪.৫৮ মিলিগ্রাম
জিংক ৩.২৭ মিলিগ্রাম

 

ভিটামিন পরিমাণ
ভিটামিন বি১ (Thiamine) ০.৬৪ মিলিগ্রাম
ভিটামিন বি২ (Riboflavin) ০.১৪ মিলিগ্রাম
ভিটামিন বি৩ (Niacin) ১২.০৭ মিলিগ্রাম
ভিটামিন বি৬ (Pyridoxine) ০.৩৫ মিলিগ্রাম
ভিটামিন বি৯ (Folate) ২৪০ মাইক্রোগ্রাম
ভিটামিন ই (Alpha-tocopherol) ৮.৩৩ মিলিগ্রাম

উল্লেখিত পুষ্টি উপাদান গুলো ছাড়াও চিনা বাদাম থেকে প্রচুর পরিমাণে এন্টি-অক্সিডেন্ট (antioxidants), ফাইটোকেমিক্যাল এবং Arginine সহ‌ সামান্য পরিমাণে কপার, সেলেনিয়াম ও ভিটামিন ডি (Vitamin D2) পাওয়া যায়।

চিনা বাদামের উপকারিতা

চিনা বাদাম নানাবিধ পুষ্টিগুণে ভরপুর যা শরীরের জন্য বিভিন্ন উপকারিতা বয়ে আনে। তো চলুন এই পর্যায়ে চিনা বাদামের ১২ টি উপকারিতা সম্পর্কে জানা যাক।

১. শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে

চিনা বাদামে প্রচুর পরিমাণে ফ্যাট বা চর্বি ও ক্যালরি রয়েছে যার ফলে অনেকেই মনে করেন যে এটি শরীরের ওজন বৃদ্ধি করে। এই ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা একটি গবেষণা করেন। গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদেরকে প্রতিদিন ১০০ গ্রাম পরিমাণ বাদাম ৮ সপ্তাহ ধরে খাওয়ানোর পর পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে যে তাদের শরীরের ওজন বেড়ে যায় নি। বরং আরেকটি গবেষনা করে দেখা গেছে যে চর্বির অন্যান্য উৎসের পরিবর্তে খাদ্য তালিকায় বাদাম যোগ করার ফলে ছয় মাসের মাথায় ৩ কেজি পর্যন্ত ওজন কমে গেছে। শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে বাদামের এই কার্যকারিতার কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীদের মতামত হলো:

  • বাদাম ক্ষুধা বোধ কমাতে সহায়তা করে
  • নাস্তা হিসেবে ফাস্টফুডের পরিবর্তে বাদাম খাওয়া স্বাস্থ্যকর অভ্যাস
  • বাদামের সব অংশ অন্ত্রের মধ্যে শোষণ (absorb) হয় না বরং কিছু অংশ মলত্যাগের মাধ্যমে শরীর থেকে বেড়িয়ে যায়
  • বাদামে থাকা প্রোটিন ও মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট হজম ও বিপাকের জন্য অনেক ক্যালরি খরচ হয় যা ওজন কমায়
  • বাদামে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে যা ওজন কমাতে সহায়তা করে

২. হার্টের রোগ প্রতিরোধ করে

বর্তমান সময়ে হার্টের রোগ (cardiovascular diseases) বিশ্বব্যাপী অকাল মৃত্যুর একটি অন্যতম প্রধান কারণ। সবচেয়ে কমন হার্টের সমস্যা গুলো হলো উচ্চ রক্তচাপ, করোনারি আর্টারি ডিজিস, হার্ট অ্যাটাক ইত্যাদি। বিভিন্ন সময়ে করা নানাবিধ গবেষণায় দেখা গেছে যে নিয়মিত বাদাম খাওয়ার ফলে হার্টের রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।

অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ একসাথে দেখতে পাওয়া যায়। এমন ব্যক্তিদের জন্য চিনা বাদাম উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে। এই ব্যাপারে ২০১৪ সালে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের উপর একটি গবেষণা চালিয়ে দেখা যায় যে প্রতিদিন ৪৬ গ্রাম পরিমাণ বাদাম খাওয়ার ফলে হার্ট ভালো থাকে।

চিনা বাদামের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ভালো মানের ফ্যাট (মনোআনস্যাচুরেটেড ও পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট) রয়েছে যা রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল (LDL- low density lipoprotein) কমাতে এবং ভালো কোলেস্টেরল (HDL- high density lipoprotein) বাড়াতে সহায়তা করে। চিনা বাদামের মধ্যে সামান্য পরিমাণে স্যাচুরেটেড ফ্যাট রয়েছে তবে মারাত্বক ক্ষতিকর ট্র্যান্স ফ্যাট নেই।

যদিও বাদামের মধ্যে সোডিয়াম (Sodium) রয়েছে যা উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার একটি কারণ। কিন্তু এর পরিমাণ খুবই কম পক্ষান্তরে অনেক বেশি পরিমাণে পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম রয়েছে যা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে থাকে। এছাড়াও অন্যান্য আরো কিছু উপাদান যেমন কপার, নিয়াসিন (Niacin), অলিক এসিড, এন্টি-অক্সিডেন্ট ইত্যাদি রয়েছে যা হার্ট ভালো রাখতে সহায়তা করে।

৩. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে

ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের জন্য Low glycemic index সমৃদ্ধ খাবার গুলো স্বাস্থ্যসম্মত কারণ তাতে রক্তে সুগারের মাত্রা সহজেই বেড়ে যায় না। চিনা বাদাম খুব ভালো মানের একটি low glycemic index সমৃদ্ধ খাবার যা রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে থাকে।

চিনা বাদামের মধ্যে শর্করার পরিমাণ খুবই কম পক্ষান্তরে বেশি পরিমাণে প্রোটিন, ফ্যাট এবং ফাইবার রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে নিয়মিত চিনা বাদাম খাওয়ার ফলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং সেই সাথে সুস্থ ব্যক্তিদের জন্য টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়।

৪. পিত্তথলিতে পাথর হওয়া প্রতিরোধ করে

পিত্তথলিতে পাথর (Gallstones) হওয়া বয়স্ক মানুষদের জন্য একটি কমন সমস্যা বিশেষত মহিলাদের ক্ষেত্রে অধিক ঝুঁকি রয়েছে। এই রোগের প্রাথমিক অবস্থায় তেমন কোনো লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায় না এবং এর চিকিৎসা ব্যবস্থা হিসেবে সার্জারি করতে হয়। কিভাবে এই রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় সেই সম্পর্কে জানতে সবারই কৌতুহল রয়েছে।

পিত্তথলিতে পাথর হওয়া ঠেকাতে চিনা বাদাম খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে যে মাঝে মধ্যেই চিনা বাদাম খেয়ে থাকেন এমন পুরুষ ও মহিলাদের ক্ষেত্রে পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম রয়েছে।  চিনা বাদামের মধ্যে Phytosterols নামক একটি বিশেষ উপাদান রয়েছে যা পিত্তথলিতে পাথর হওয়া প্রতিরোধে সহায়তা করে থাকে।

৫. প্রদাহ নাশক (Anti-inflammatory) হিসেবে কাজ করে

প্রদাহ জনিত রোগ যেমন রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস (Rheumatoid arthritis), পাকস্থলীতে আলসার, বাতব্যথা (Gout) ইত্যাদিতে ওষুধের পাশাপাশি পথ্য হিসেবে চিনা বাদাম খাওয়া উপকারি হতে পারে।‌ কারণ চিনা বাদামের মধ্যে ফাইবার, এন্টি-অক্সিডেন্ট ও ফাইটোকেমিক্যাল রয়েছে যা প্রদাহ নাশক হিসেবে কাজ করে।

৬. ক্যান্সার প্রতিরোধ করে

গবেষণায় দেখা গেছে যে বয়স্কদের জন্য নিয়মিত বাদাম খাওয়ার ফলে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি কমে যায় বিশেষত পাকস্থলীর ক্যান্সার যাকে মেডিকেলের ভাষায় gastric non cardia adenocarcinoma বলা হয়। এছাড়াও এন্টি-অক্সিডেন্ট ও ফাইটোকেমিক্যাল এর প্রভাবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায় যার ফলে যে কোনো রোগে আক্রান্ত হওয়া সহ ইনফেকশন প্রতিরোধে সহায়তা করে।

৭. যৌন সক্ষমতা বৃদ্ধি করে

যৌন সমস্যায় ভুগছেন এমন মানুষের সংখ্যা অনেক যার মধ্যে সবচেয়ে কমন একটি সমস্যা হলো ইরেকটাইল ডিসফাংশন (Erectile dysfunction, ED) বা লিঙ্গ উত্থান না হওয়া। এই সমস্যা প্রতিকারে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে তবে পাশাপাশি সহায়ক খাবার হিসেবে বাদাম খাওয়া উপকারি হতে পারে।

কারণ চিনা বাদামের মধ্যে Arginine নামক যে উপাদানটি রয়েছে তা লিঙ্গের মধ্যে রক্ত প্রবাহ বৃদ্ধি করার মাধ্যমে ইরেকটাইল ডিসফাংশন দূর করতে সহায়তা করে। এছাড়াও বাদামে বিদ্যমান ভিটামিন ই এবং মিনারেলস সমূহ শুক্রাণুর সংখ্যা ও গুণগত মান বৃদ্ধি করে।

৮. ভোজ্যতেল হিসেবে চিনা বাদামের তেল

চিনা বাদামের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে তেল রয়েছে যা বাজারে Peanuts oil নামে কিনতে পাওয়া যায়। এই তেল স্বাস্থ্যসম্মত এবং খাওয়ার মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন উপকার হয়ে থাকে। যেমন:

  • রক্তে কোলেস্টেরলের ভারসাম্য বজায় রাখে এবং হার্ট ভালো রাখে
  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে
  • চিন্তা করার সক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং স্মৃতি শক্তি ভালো রাখে

৯. জয়েন্ট ব্যাথায় বাদাম তেল

বাত (Gout) ও রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এর ফলে অনেকের ক্ষেত্রেই হাঁটু ব্যথা হতে দেখা যায় বিশেষত বয়স্কদের জন্য এটি একটি কমন সমস্যা। ব্যথা নাশক ওষুধ সেবন করা কিডনির জন্য ক্ষতিকর আর তাই সামান্য ব্যথায় ওষুধ না খেয়ে বরং প্রাকৃতিক ও নিরাপদ পদ্ধতি হিসেবে চিনা বাদামের তেল ব্যথার স্থানে মালিশ করা যেতে পারে। তেল হালকা গরম করে ম্যাসাজ (massage) করার ফলে ব্যথা নিরাময় হয়ে থাকে। তবে অতিরিক্ত ব্যথা হলে সেক্ষেত্রে একজন চিকিৎসক বা ফিজিওথেরাপিস্ট এর শরণাপন্ন হতে হবে।

১০. ত্বকের মসৃণতা ও উজ্জ্বলতা বাড়ায়

চিনা বাদামের মধ্যে ভিটামিন ই রয়েছে যা এন্টি এজিং (anti-aging) হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ ত্বকে বয়সের ছাপ দূর করে এবং সেই সাথে ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে থাকে।

এছাড়াও ত্বকের রুক্ষতা দূর করতে চিনা বাদামের তেল ব্যবহার করতে পারেন। সেক্ষেত্রে মুখে ও শরীরের অন্যান্য জায়গায় তেল মাখিয়ে ২০ মিনিট পর গোসল করে ফেলুন।

১১. খুশকি দূর করে

মাথায় খুশকি (Dandruff) দূর করতে চিনা বাদামের তেল ব্যবহার করতে পারেন। খুশকি দূর করতে তেলের সাথে সহায়ক উপাদান হিসেবে কয়েক ফোঁটা লেবুর রস যোগ করে মিশ্রণ তৈরি করুন। অতঃপর ভালো ভাবে মাথার ত্বকে লাগান এবং ২ থেকে ৩ ঘন্টা পরে গোসল করে নিন।

অনেকের ক্ষেত্রে মাথার ত্বকে সোরিয়াসিস (Psoriasis) নামক চর্মরোগ হয়ে থাকে যা নিরাময়ের ক্ষেত্রে সহায়ক উপাদান হিসেবে চিনা বাদামের তেল ব্যবহার করা উপকারি হতে পারে। তবে কারো ক্ষেত্রে চিনা বাদামের তেলে এলার্জি থাকলে ব্যবহার না করাই উত্তম।

১২. চুল গজাতে সহায়তা করে

ভিটামিন ই ও উপকারী ফ্যাট সমৃদ্ধ চিনা বাদামের তেল নিয়মিত ব্যবহারের ফলে মাথায় নতুন চুল গজায়। প্রতিদিন স্বাভাবিক ভাবেই মাথা থেকে অনেক গুলো চুল পড়ে যায় আর সেই সাথে নতুন করে যাদের চুল গজায় না তাদের মাথায় চুল পাতলা হয়ে যায়। আর তাই নতুন চুল গজানোর জন্য নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের পাশাপাশি চিনা বাদামের তেল ব্যবহার করুন।

গর্ভাবস্থায় চিনা বাদামের উপকারিতা

চিনা বাদামের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ফলেট বা ফলিক এসিড রয়েছে যা গর্ভকালীন সময়ে অনেক বেশি পরিমাণে প্রয়োজন হয়ে থাকে। চিনা বাদাম খাওয়ার মাধ্যমে ফলেট পাওয়া যায় যা বাচ্চার জন্মগত ত্রুটি হওয়ার ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে। এছাড়াও চিনা‌ বাদামে বিদ্যমান উপকারী ফ্যাট এবং মিনারেলস সমূহ বাচ্চার শরীর গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

গর্ভাবস্থায় চিনা বাদাম খাওয়া যাবে যদি না আপনার ক্ষেত্রে তাতে এলার্জি দেখা দেয়। এলার্জি হলে সেক্ষেত্রে লক্ষণ হিসেবে দেখা যায় বমি বমি ভাব, পেটে ব্যথা, চোখের পাতা ও মুখমণ্ডল ফুলে যাওয়া ইত্যাদি। এমন পরিস্থিতিতে অবশ্যই বাদাম খাওয়া বাদ দিতে হবে এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

চিনা বাদামের উপকারিতা ও অপকারিতা

চিনা বাদামের নানাবিধ পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা রয়েছে তবে এর পাশাপাশি কিছু অপকারিতা রয়েছে। চিনা বাদামের তিনটি কমন অপকারিতা সম্পর্কে নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:

Aflatoxin পয়জনিং

কাঁচা বাদাম ভালো ভাবে সংরক্ষণ করা না হলে তাতে একপ্রকার ছত্রাকের (Aspergillus flavus) সংক্রমণ হতে পারে যা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে একটি বিষাক্ত উপাদান (Aflatoxin) তৈরি করে। এই উপাদানটি মূলত লিভারের (Liver) উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে যার লক্ষণ হিসেবে দেখা যায় চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া এবং ক্ষুধামন্দা। ছত্রাকের আক্রমণ প্রতিরোধে কাঁচা বাদাম শুষ্ক জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে।

আয়রন ও জিংক শোষণে বাঁধা

বাদামের মধ্যে phytic acid নামক একটি উপাদান রয়েছে যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয় বরং উপকারী। তবে যাদের শরীরে আয়রন অথবা জিংকের ঘাটতি রয়েছে এমন ব্যক্তিদের জন্য এই উপাদানটি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ phytic acid অন্ত্রের মধ্যে আয়রন ও জিংক শোষণে বাঁধার সৃষ্টি করে থাকে। আর তাই আয়রন অথবা জিংকের অভাব পূরণের জন্য সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করেন এমন ব্যক্তিদের জন্য বেশি পরিমাণে বাদাম খাওয়া উচিত হবে না।

চিনা বাদামে এলার্জি (allergy)

বাদাম খাওয়ার ফলে এলার্জি হওয়া অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয় কারণ চিনা বাদাম একটি কমন allergen foods যা এলার্জি সৃষ্টি করে থাকে। তবে এটি সবার ক্ষেত্রেই এলার্জি সৃষ্টি করবে এমনটি নয় বরং ব্যক্তিভেদে একেক জনের একেক খাবারে এলার্জি দেখা দেয়‌। বাদাম খাওয়ার ফলে এলার্জি দেখা দিলে সেক্ষেত্রে তা এড়িয়ে চলা উচিত।

এছাড়াও আরেকটি বিষয় হলো যে কোনো খাবার বেশি পরিমাণে খেলে তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। আর তাই গল্পের তালে তালে অথবা ভালো লাগছে বলেই একবারে বেশি পরিমাণে চিনা বাদাম খাওয়া যাবে না। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য দৈনিক সর্বোচ্চ ১০০ গ্রামের বেশি বাদাম খাওয়া উচিত নয়। বরং শরীরে কোনো রোগ বা সমস্যা থাকলে সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী খাবার গ্রহণ করতে হবে।

কাঁচা চিনা বাদামের উপকারিতা

বাদাম কাঁচা খাওয়া ভালো নাকি ভাজা সেই প্রশ্নের উত্তর হলো কাঁচা খেলে সেক্ষেত্রে তাতে সব ধরনের পুষ্টিগুণ অক্ষুন্ন থাকে। পক্ষান্তরে আগুনের তাপে ভাজা হলে তাতে করে বাদামে থাকা ভিটামিন ও এন্টি-অক্সিডেন্ট নষ্ট হয়ে যায়। আর ভিটামিন ও এন্টি-অক্সিডেন্ট শরীরের জন্য অনেক উপকারী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই সাথে কাঁচা বাদামের মধ্যে পানি রয়েছে যা ভাজা বাদামে তুলনামূলক কম থাকে।

তবে কাঁচা বাদাম খাওয়া অনেকের কাছেই সুস্বাদু নাও মনে হতে পারে। কারো ক্ষেত্রে আবার কাঁচা বাদাম খাওয়ার ফলে বমি বমি ভাব বা বমি হতে দেখা যায়। আপনার ক্ষেত্রে এমন সমস্যা হলে কাঁচা বাদাম না খেয়ে বরং ভাজা বাদাম খাওয়ারই অভ্যাস করুন। এছাড়াও ভালোভাবে ধুয়ে না নিলে সেক্ষেত্রে জীবাণুর (ছত্রাক, প্যারাসাইট, ব্যাকটেরিয়া) সংক্রমণ হতে পারে। আর তাই কাঁচা বাদাম খাওয়ার আগে অবশ্যই তা ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে।

ভাজা চিনা বাদামের উপকারিতা

ভাজা বাদামে পানি, ভিটামিন ও এন্টি-অক্সিডেন্ট এর পরিমাণ কিছুটা কমে যায় তবে অন্যান্য সব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান একদম ঠিক থাকে। সেই সাথে তেলে ভাজা বাদামে ক্যালরির পরিমাণ বেশি থাকে। সুতরাং স্বাদ ও বেশি ক্যালরি পেতে চাইলে ভাজা বাদাম খাওয়া আপনার জন্য সুবিধাজনক হবে। এছাড়াও সংরক্ষণের বিষয়টি বিবেচনায় কাঁচা বাদামের তুলনায় ভাজা বাদাম বেশি দিন ভালো থাকে।

তবে অনেকেই ভাজা বাদাম হালকা লবণ সহযোগে মজা করে খেয়ে থাকেন। এটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে বিশেষত তা রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। লবণে থাকা সোডিয়াম উচ্চ রক্তচাপের একটি প্রধান কারণ আর তাই খেয়াল রাখতে হবে যেনো বাদাম খাওয়ার সাথে অনেকটা লবণ খেয়ে ফেলা না হয়।

চিনা বাদামের খোসার উপকারিতা

চিনা‌ বাদামের উপরে যে পাতলা আবরণ থাকে তা ফেলে না‌ দিয়ে বরং খাওয়া উচিত। কারণ এর মধ্যে অনেক পুষ্টিগুণ রয়েছে।‌ বিশেষত এন্টি-অক্সিডেন্ট ও ফাইটোকেমিক্যাল এর বেশিরভাগ অংশ রয়েছে বাদামের এই খোসার মধ্যে। এটি খেতে মন্দ তা নয় বরং বাদামের উপরের খোসা ছাড়িয়ে ফেলার পর অভ্যাসবশত সবাই বাদামী রঙের পাতলা আবরণ ঘসে তুলে ফেলে। বাদাম থেকে উপকারী এন্টি-অক্সিডেন্ট ও এন্টি ইনফ্লামেটরি গুণাবলী পেতে হলে আজই এই অভ্যাস পরিবর্তন করুন। পাতলা আবরণ সহ চিনা বাদাম দেখতে মোটেও খারাপ নয় এবং খেতেও সুস্বাদু।

বাদাম কত ধরনের হয়?

বাদামের অসংখ্য ধরন ও প্রকরণ রয়েছে যার মধ্যকার ৯ টি ধরন মোটামুটি জনপ্রিয়। ইতিমধ্যেই আপনারা চিনা বাদামের উপকারিতা, অপকারিতা ও খাওয়ার সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। এই পর্যায়ে বাকি ৮ ধরনের বাদাম সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা যাক।

১. কাঠ বাদামের উপকারিতা (Almonds)

কাঠবাদামের মধ্যে চিনা বাদামের চেয়েও বেশি পুষ্টিগুণ রয়েছে যা শরীরের জন্য বেশ উপকারী। নিয়মিত কাঠবাদাম খাওয়ার মাধ্যমে যে সমস্ত উপকারিতা পাওয়া যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হার্টের রোগ প্রতিরোধ করে, শরীরের অতিরিক্ত ওজন ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে, হজম শক্তি বাড়ায়, ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে ইত্যাদি। কাঠ বাদামের তেল মাথায় ব্যবহারের মাধ্যমে মাথার ত্বক ভালো থাকে এবং চুল পড়া রোধ করে। এছাড়াও কাঠবাদাম বেটে পেস্ট তৈরি করে মুখের ত্বকে লাগানোর মাধ্যমে বলিরেখা দূর হয় এবং ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়।

২. পেস্তা বাদামের উপকারিতা (Pistachios)

পেস্তাবাদামে (Pistachios) তুলনামূলক কম ক্যালরি ও ফ্যাট রয়েছে তবে অন্যান্য পুষ্টিগুণ রয়েছে বেশি পরিমাণে। বিশেষত প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন বি৬ রয়েছে যা শরীরের বিপাক প্রক্রিয়ায় (metabolism) সহায়তা করে।

এছাড়াও পেস্তাবাদামে বিদ্যমান কিছু বিশেষ উপাদান যেমন carotenoids, lutein, zeaxanthin, anthocyanins, flavonoids, proanthocyanidins ইত্যাদি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং বিভিন্ন ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।

৩. আখরোটের উপকারিতা (Walnuts)

অন্যান্য বাদামের মতোই আখরোট (Walnuts) বিভিন্ন পুষ্টিগুণে ভরপুর তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে রয়েছে কপার। প্রতি ১০০ গ্রাম আখরোট থেকে যে পরিমাণ কপার পাওয়া যায় তা দৈনিক চাহিদার অর্ধেক পূরণ করে। কপার শরীরে শক্তি উৎপাদন, স্নায়ুতন্ত্রের কার্যক্রম, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদিতে সহায়তা করে থাকে।

প্রতিদিন ১ থেকে ২ আউন্স পরিমাণ আখরোট খাওয়া হলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং Dementia হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। উল্লেখ্য Dementia হলো এমন একধরনের রোগ যেখানে সহজেই ভুলে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়।

৪. কাজু বাদামের উপকারিতা (Cashews)

কাজুবাদাম (Cashews) মিষ্টান্ন বা অন্যান্য খাবার তৈরিতে স্বাদ ও গন্ধ (smell) বৃদ্ধির জন্য বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে তবে এটি কাঁচা অথবা ভাজা অবস্থায় সরাসরি খাওয়া যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে রয়েছে ভিটামিন কে (Vitamin K) যা রক্ত জমাট বাঁধতে সহায়তা করে থাকে।

৫. পেকান বাদামের উপকারিতা (Pecans)

পেকান (Pecans) একধরনের বাদাম যা সালাদ হিসেবে অথবা কেক তৈরিতে বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে রয়েছে জিংক এবং ম্যাঙ্গানিজ। জিংক মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে আর ম্যাঙ্গানিজ হাড়ের গঠন ও যৌন হরমোন উপাদানে সহায়তা করে থাকে।

৬. ম্যাকাডামিয়ার উপকারিতা (Macadamia)

ম্যাকাডামিয়া (Macadamia) বাদাম আমাদের দেশে খুব বেশি প্রচলিত না হলেও অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের দেশগুলোতে এটি বেশ জনপ্রিয়। এর মধ্যে কার্বোহাইড্রেট কম রয়েছে তবে বেশি পরিমাণে উপকারী ফ্যাট আছে যা হার্ট ভালো রাখতে সহায়তা করে। এছাড়াও প্রচুর পরিমাণে রয়েছে ভিটামিন বি১ এবং ম্যাঙ্গানিজ সহ অন্যান্য উপাদান।

৭. ব্রাজিল নাটের উপকারিতা (Brazil nuts)

ব্রাজিল নাট (Brazil nuts) প্রচুর পরিমাণে সেলেনিয়াম নামক খনিজ উপাদান সমৃদ্ধ একটি বাদাম। সেলেনিয়ামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ হলো থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখা। উল্লেখ্য বর্তমান সময়ে থাইরয়েড গ্রন্থির রোগ যেমন হাইপোথাইরয়েডিজম এবং হাইপারথাইরয়েডিজম খুবই কমন।

৮. হ্যাজেল বাদামের উপকারিতা (Hazelnut)

হ্যাজেল বাদামের (Hazelnut) মধ্যে অন্যান্য বাদামের মতোই বিভিন্ন পুষ্টিগুণ রয়েছে তবে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে রয়েছে ভিটামিন ই এবং ম্যাঙ্গানিজ। এছাড়াও কিছু বিশেষ উপাদান যেমন gallic acid, epicatechin, caffeic acid, quercetin ইত্যাদি রয়েছে যা প্রদাহ নাশক হিসেবে কাজ করে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।

অন্যান্য বাদামের তুলনায় চিনা বাদাম কিছুটা কম পুষ্টিগুণ সম্পন্ন তবে এটি বেশ সস্তায় পাওয়া যায়। সর্বোপরি সব ধরনের বাদামই পুষ্টিগুণ সম্পন্ন আর তাই আপনার সুবিধা এবং পছন্দ অনুযায়ী আপনি যেকোন একটি নিয়মিত খাওয়ার অভ্যাস করতে পারেন। তবে সবধরনের বাদামই মাঝে মধ্যে খাওয়া উচিত।