কিসমিস, কত প্রকার? উপকারিতা ও অপকারিতা এবং খাওয়ার নিয়ম

কিসমিস মূলত শুকানো আঙুর। ইরাক, ইরান, পাকিস্তান, এবং ভারতে উৎপাদিত এই মিষ্টি খাবারটি এক কথায় পুষ্টির আধার। ভিটামিন, মিনারেলস, ফাইবার, নিউট্রিয়েন্টস, অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস, আয়রন, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়ামে ভরপুর কিসমিস দেহ নিরোগ রাখতে অতুলনীয়।
কিসমিস বা রসায়ন বিজ্ঞান একটি বিজ্ঞানের শাখা যা প্রধানভাবে মৌল ও অ্যানায়নের গঠন, বৈশিষ্ট্য, রাসায়নিক প্রক্রিয়া, এবং তাদের পরিবর্তনের উপর কেন্দ্রিত। এটি প্রকৃতির বিভিন্ন ঘটনা ও প্রক্রিয়ার বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং মানব জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ পায়।
কিসমিস কত প্রকার?
বাদামী কিসমিস – এই কিসমিস তিন সপ্তাহ ধরে আঙ্গুর শুকিয়ে তৈরি করা হয়। শুকানোর পরে এগুলি বাদামী হয়ে যায়। এটি তৈরি করতে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধরনের আঙ্গুর ব্যবহার করা হয়। তাদের রঙ, আকার এবং স্বাদ আঙ্গুর ধরনের উপর নির্ভর করে।
সুলতানা (গোল্ডেন রেজিন) – সুলতানা আঙ্গুর (বীজহীন সবুজ গোলাকার আঙ্গুর) শুকিয়ে এই কিশমিশ তৈরি করা হয়। এই ধরনের কিশমিশ তৈরি করতে আঙুর শুকানোর আগে এক ধরনের তৈলাক্ত দ্রবণে ভিজিয়ে রাখা হয়। এই কারণে, এই কিশমিশের রঙ সোনালি/হালকা বাদামী। এই কিশমিশটি প্রায়শই আকারে ছোট এবং অন্য দুটি কিশমিশের তুলনায় স্বাদে মিষ্টি হয়।
বেদানা (কালো কিসমিস) – এই ধরণের কিসমিসকে বেদানাও বলা হয় এবং এটি কালো আঙ্গুর থেকে তৈরি করা হয়। এগুলোও তিন সপ্তাহ ধরে আঙ্গুর শুকিয়ে তৈরি করা হয়। এদের স্বাদ প্রায়ই টক-মিষ্টি এবং আকারে ছোট। অন্যান্য আঙ্গুরের মতো কালো কিসমিস খাওয়ার উপকারিতা কি, তাও বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে।
কিসমিসের উপকারিতা
প্রতি ১০০ গ্রাম পরিমাণ কিসমিস থেকে ২৯৯ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়। সেই সাথে এতে রয়েছে ৭৯ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ৩.১ গ্রাম প্রোটিন, ০.৫ গ্রাম ফ্যাট, ১১ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ৭৪৯ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম সহ সামান্য পরিমাণে অন্যান্য মিনারেলস এবং ভিটামিন।
রক্তশূন্যতা দূর করে
রক্তশূন্যতার অন্যতম কারণ হলো শরীরে আয়রনের অভাব। এই সমস্যায় শরীরে পর্যাপ্ত লোহিত রক্ত কণিকা তৈরি হয় না, যা শরীরে অক্সিজেন সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায়। শরীরে আয়রনের অভাব পূরণ করতে কিসমিস খুবই কার্যকরি ভূমিকা পালন করে। কিসমিসকে আয়রনের একটি সমৃদ্ধ উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
হার্টের রোগের ঝুঁকি কমায়
উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের ক্ষেত্রে জটিলতর হার্টের রোগ যেমন হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। কিন্তু আপনি যদি নিয়মিত কিসমিস খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন, তাহলে এতে বিদ্যমান পটাশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রেখে হার্টের রোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করবে। এছাড়াও এতে সোডিয়ামের পরিমাণ খুবই সামান্য যা রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয় না বরং এর মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে যা রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হার্ট ভালো রাখে।
ক্যান্সার প্রতিরোধ করার উপায়
কিসমিস অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর খুব ভালো একটি উৎস। বিশেষত এর মধ্যে প্রচুর পরিমাণে Phenolic phytochemicals রয়েছে যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর ফ্রি র্যাডিক্যালস এর বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ক্যান্সার প্রতিরোধ করে থাকে। এছাড়াও নিয়মিত কিসমিস খাওয়ার ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়। যার ফলে সহজেই শরীরে রোগজীবাণুর সংক্রমণ হতে পারে না এবং সেই সাথে রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
ত্বক, চুল ও চোখ ভালো রাখে
কিসমিসের মধ্যে resveratrol নামক বিশেষ একটি উপাদান রয়েছে যা ত্বক ও চুলের যত্নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিয়মিত কিসমিস খাওয়ার ফলে ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়, মাথায় খুশকি হওয়ার প্রবণতা দূর হয় এবং চুল পড়া কমে যায়। এছাড়াও কিসমিসে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর উপস্থিতি বার্ধক্য জনিত চোখের ঝাপসা দৃষ্টি এবং ছানিপড়া রোগ (Cataract) প্রতিরোধে সহায়তা করে।
পুরুষের যৌন সক্ষমতা বৃদ্ধি করে
কিসমিস হলো প্রাকৃতিক যৌন উদ্দীপক (Aphrodisiac) খাবার যা একজন পুরুষের ক্ষেত্রে যৌন সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। বিশেষত লিঙ্গে রক্ত প্রবাহ বৃদ্ধি করার মাধ্যমে লিঙ্গ উত্থান জনিত সমস্যা (ED- erectile dysfunction) দূর করে। সেই সাথে এতে বিদ্যমান arginine নামক বিশেষ একটি উপাদান শুক্রাণুর গুণগত মান বৃদ্ধি করে যা সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য অত্যাবশ্যক।
অ্যাসিডিটিতে উপকারী
অ্যাসিডিটি একটি সাধারণ সমস্যা, যাতে বুক থেকে পেট পর্যন্ত জ্বালাপোড়া অনুভূত হয়। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে কিসমিস খান। অম্লতা কমাতে সাহায্য করে এমন খাবারে কিশমিশ অন্তর্ভুক্ত করুন। কিসমিসের ক্ষারীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা শরীরে অ্যাসিডের পরিমাণ স্বাভাবিক করতে সাহায্য করে।
মুখ ও দাঁতের সমস্যা দূর করে
কিশমিশ মুখ ও দাঁতের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। প্রকৃতপক্ষে, ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অফ ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন দ্বারা পরিচালিত একটি সমীক্ষা অনুসারে কিসমিস দাতের গহ্বরে থাকা জীবাণু প্রতিরোধ করতে পারে। গবেষকদের মতে, কিসমিসে রয়েছে ফাইটোকেমিক্যাল, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ওলিয়ানোলিক অ্যাসিড, যা দাঁতের ক্যারিস সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি রোধ করতে সাহায্য করে। এছাড়াও, কিশমিশে পাওয়া ফাইটোকেমিক্যালগুলো মুখের মধ্যে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া যেমন Mutans Streptococci, যা গহ্বর সৃষ্টি করে, দাঁতের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে।
কিসমিস খাওয়ার অপকারিতা
কিসমিস খাওয়ার অপকারিতা” বলতে গেলে বোঝানো হয়ে থাকে রাসায়নিক পদার্থের অপ্রয়োজনীয় বা অনিরাপদ ভাবে খাওয়া বা গ্রহণ করার নেতিবাচক প্রভাব। শারীরিক উপকারের পাশাপাশি কিসমিস খাওয়ার কিছু অপকারিতাও রয়েছে। এটি অত্যধিক পরিমাণে সেবন করলে নিম্নলিখিত সমস্যা হতে পারে, যেমন-
- শরীরের ওজন বৃদ্ধি
- এলার্জি
- ডায়রিয়া এবং গ্যাস
- টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি
এছাড়া যেমন
টক্সিকিটি: অনেক রাসায়নিক পদার্থ হতে পারে টক্সিক বা বিষাক্ত, যা অবশ্যই জীবনের জন্য ক্ষতিকর।
এলার্জি ও প্রতিক্রিয়া: কিছু রাসায়নিক পদার্থ এলার্জিক প্রতিক্রিয়া বা অন্যান্য ধরনের ব্যাধির জন্য দায়ী হতে পারে।
অপূর্ণ জানা: অনেক ক্ষেত্রে, রাসায়নিক পদার্থের দীর্ঘকালিক প্রভাব সম্পর্কে পূর্ণরূপে জানা হয়নি, যা বিপদজনক হতে পারে।অভ্যাসের জন্য ক্ষতি: অতিরিক্ত খাওয়া বা অভ্যাসে কিছু রাসায়নিক পদার্থের ক্ষতিকর প্রভাব হতে পারে, যেমন ক্যাফিন, অ্যালকোহল, নিকোটিন ইত্যাদি।
প্রজনন ও জন্ম দোষ: কিছু রাসায়নিক পদার্থ প্রজননে ক্ষতি করতে পারে বা জন্মে দোষ সৃষ্টি করতে পারে।
কিসমিস খাওয়ার নিয়ম
কিসমিস এর সম্পূর্ণ উপকারিতা পেতে হলে আপনাকে অবশ্যই নিয়ম মেনে খেতে হবে। বিভিন্ন সমস্যায় কিসমিস কিভাবে খাবেন তা আপনারা এতক্ষন জানলেন। এবার জানুন কিসমিস দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় স্বাস্থ্যকর উপায়ে কিভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে-
- কিসমিস পিনাট বাটার এবং ফ্রুট সালাদের সাথে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে।
- কিসমিসের সাথে ব্রকলি এবং গাজর (বা ঋতু অনুযায়ী যেকোনো সবজি) সালাদ হিসেবে খাওয়া যেতে পারে।
- সকালের নাস্তায় ওটসে চিনির পরিবর্তে কিসমিস ব্যবহার করুন।
- এটি মাফিন এবং প্যানকেকগুলিকে মিষ্টি করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
- কিসমিস সরাসরি খাওয়া যায়।
খাওয়ার পরিমাণ: শুকনো ফল সব বয়সের মানুষের জন্য উপকারী। দিনে 50-100 গ্রাম কিসমিস খাওয়া যেতে পারে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য, এর পরিমাণ তাদের খাদ্য এবং ওষুধ অনুসারে হতে হবে, যার জন্য ডাক্তারের সাথে পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।